তার পূর্বসূরী বঙ্কিমচন্দ্রের লেখনীতে ইতিহাস বর্ণময় হয়ে উঠেছিল, আর শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলমে ইতিহাস গল্পময়। ঐতিহাসিক গল্প-উপন্যাসের লেখক হিসেবে শরদিন্দুর নাম বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বঙ্কিমচন্দ্রের পরেই উচ্চারিত। 'বহু দূরকালের সামান্য কয়খানা ঘটনার কঙ্কালের মধ্যে তিনি প্রতিভার মন্ত্রবলে প্রাণসঞ্চার' করে যে-কালজয়ী আখ্যানমালা রচনা করেছিলেন তা যেন সর্বকালের 'ঐতিহাসিক' সম্পদ। ইতিহাস সম্পর্কে শরদিন্দুর আজন্ম আগ্রহ ছিল। তিনি
ছিলেন ভারতের অতীত ইতিহাসের একনিষ্ঠ পাঠক। ফলে, প্রায় লেখকজীবনের গোড়া থেকেই তিনি ইতিহাসের ভেতরে গল্পের অনুসন্ধান করেছেন,
ইতিহাসকে গল্পের ভেতরে বন্দি করেছেন অভিনব কৌশলে। সুকুমার সেন দেখিয়েছেন: 'প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত শরদিন্দুবাবুর ঐতিহাসিক গল্পের কালপ্রসার। এর মধ্যে কোথাও গল্পের পরিবেশ গল্পরসের তীক্ষ্ণতার হানি করেনি। দূরের দৃশ্যপটকে নিকটে এনে দূরের মানুষকে কাছের মানুষ করতে পেরেছেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়।' এ বিষয়ে তিনি ছিলেন সার্থক ও সতর্ক স্রষ্টা। এক সাক্ষাৎকারে শরদিন্দু বলেছিলেন: 'ইতিহাস থেকে চরিত্রগুলো কেবল নিয়েছি; কিন্তু গল্প আমার নিজের। সর্বদা লক্ষ্য রেখেছি কি করে সেই যুগকে ফুটিয়ে তোলা যায়। যে সময়ের গল্প তখনকার রীতি নীতি, আচার ব্যবহার, অস্ত্র, আহার, বাড়িঘর ইত্যাদি খুঁটিনাটি সব জানা না থাকলে যুগকে ফুটিয়ে তোলা যায় না। এরপর আছে ভাষা। ঐতিহাসিক গল্পের ভাষাও হবে যুগোপযোগী।' রহস্যসন্ধানী ব্যোমকেশ বক্সীর অমর স্রষ্টা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইতিহাস-আশ্রিত গল্প-উপন্যাসে কাহিনী ও ইতিহাস যুগপৎ 'জীবন্ত' হয়ে উঠেছে। বৌদ্ধযুগ, গৌড়বঙ্গ, চৈতন্যযুগ, প্রাক-মুঘল কিংবা মুঘল যুগ অথবা অদূর অতীতের পোর্তুগিজ-ইংরেজ অধিকৃত বাংলার সমকাল দুর্নিবার হয়ে উঠেছে কল্পনা ও বর্ণনার অশেষ গুণে, রচনা ও গল্পরসের অনিবার্য সৃষ্টিতে। তিনি বলতেন: 'ইতিহাসের গল্প লিখেই বেশি তৃপ্তি পেয়েছি।' পরিশ্রমী সম্পাদনায় দুই মলাটের মধ্যে সাজিয়ে দেওয়া শরদিন্দুর সমস্ত ইতিহাস-নির্ভর উপন্যাস (পাঁচটি) এবং গল্প (সতেরোটি) পাঠকদের তৃপ্তি দেবে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি